ভৈরব উপজেলার ইতিহাস,কিশোরগঞ্জ।
ভৈরব উপজেলা,কিশোরগঞ্জ।
অবস্থান:
১৯০৬ সালে ভৈরব থানা প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ১৯৮৩ সালের ১৫ এপ্রিল থানাটি মানোন্নীত হয়েছে। ভৈরব পূর্বে বৃহত্তর ময়মনসিংহ এবং বর্তমানে কিশোরগঞ্জ জেলার প্রশাসনিক অধিভুক্ত। পূর্ব দিকে মেঘনা নদী (নদীর অপর প্রান্তে বি.বাড়ীয়া জেলার সরাইল উপজেলা), উত্তর-পূর্ব কোণে কিশোরগঞ্জ জেলার বাজিতপুর, উত্তর-পশ্চিম কোণে কিশোরগঞ্জ জেলার কুলিয়ারচর, পশ্চিম ও দক্ষিণ কোণে নরসিংদী জেলার বেলাব এবং রায়পুরা, পূর্ব-দক্ষিণ কোণে বি. বাড়ীয়া জেলার আশুগঞ্জ উপজেলার সীমানা।
প্রশাসনঃ
ভৈরবে ৭টি ইউনিয়ন, ৯টি ওয়ার্ড, ২৪টি মহল্লা, ১টি পৌরসভা (১২টি ওয়ার্ড), ৩২টি মৌজা ও ৮৪টি গ্রাম রয়েছে।
ভৈরব উপজেলার ইউনিয়নগুলো হচ্ছেঃ * সাদেকপুর, * শ্রীনগর, * আগানগর, * শিমুলকান্দি, * শিবপুর, * কালিকাপ্রাসাদ, * গজারিয়া।
নাম করণঃ
১৭৬৪ থেকে ১৭৭৩ সালের মধ্যে অংকিত ও ১৭৮১ সালে প্রকাশিত জেমস জে. রেনেলের অবিভক্ত বাংলার মানচিত্রে ভৈরব নামক ভূখন্ডের অস্তিত্ব পাওয়া যায় না। ব্রহ্মপুত্র নদ সে সময় ১০ থেকে ১২ মাইল প্রশস্ত ছিল, মেঘনা ছিল ব্রহ্মপুত্রের উপ-নদী। মেঘনা ও ব্রহ্মপুত্রের মিলনস্থলে সৃষ্ট বালির চর বর্তমানে জনপদ ভৈরব । জেগে উঠা চরাঞ্চল ও জলাভূমিতে উলু-খাগড়ার বন জন্মানোর কারণে স্থানটির প্রথম নাম হয় উলুকান্দি। উলুকান্দি তৎকালীন ভাগলপুর দেওয়ানদের জমিদারীর অন্তভূক্ত হলো। নবীনগর উপজেলার বিটঘরের দেওয়ান ভৈরব চন্দ্র রায় ভাগলপুরের জমিদার দেওয়ান সৈয়দ আহমদ রেজা এর কাজ থেকে মৌখিক অনুমতি নিয়ে উলুকান্দি ও পার্শ্ববর্তি এলাকায় জনবসতি শুরু করেন। জনবসতির পাশাপাশি একটি বাজার গড়ে উঠে । দেওয়ান ভৈরব চন্দ্র রায় তাঁর মা’র নামে বাজারটির নাম দেন কমলগঞ্জ প্রকাশ্যে ভৈরব বাজার। পার্শ্ববর্তি গ্রামগুলোর নাম দেয়া হয় তাঁর ভাই-বোনদের নামানুসারে ভৈরবপুর, কমলপুর, জগন্নাথপুর, শম্ভুপুর, কালীপুর, চনিডবের ও লক্ষীপুর। জমিদার ভৈরবের বিভিন্ন অংশের নাম হিন্দু সংস্কৃতির ধারায় রেখে দেন। ভৈরবপুর,শম্ভূপুর, জগন্নাথপুর, চণ্ডিবের, শিবপুর, কালীপুর,কালিকাপ্রসাদ, ইত্যাদি পাড়া/মহল্লার নামে হিন্দু সংস্কারের প্রভাব সুস্পষ্ট। ভৈরবের আদি নাম ছিল উলুকান্দি।
প্রথম মুসলমান ব্যবসায়ী হিসেবে যিনি ভৈরব রায়ের জমিদারীতে আসেন তিনি হলেন শ্রীযুক্ত হাজী শেখ নূর মোহাম্মদ মিয়া। তিনি একজন তীক্ষ্ম বুদ্ধিসম্পন্ন ও সফল ব্যবসায়ী হিসেবে অচিরেই ভৈরবে তার আধিপত্য বিস্তার করেন। তিনি একজন ধনাঢ্য ব্যবসায়ী ছিলেন এবং সেই ব্রিটিশ আমলে তিনি হাতিতে করে চলাফেরা করতেন। জমিদার ভৈরব রায় তার জমিদারী সুপরিচালনা করার জন্য ভৈরব বাজারে রাজকাচারী ভবন প্রতিষ্ঠা করেন। যা এখন উপজেলা ভূমি অফিস হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
ঐতিহাসিক ঘটনাবলীঃ
১৯৭১ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় এই উপজেলার হালগারাতে পাক আর্মিরা ৩০০ নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করে।
তৎকালীন ভৈরব বাজারে পাক বাহিনী ঘাটি গড়ে তুলে। যুদ্ধের শেষ সময়ের দিকে তারা ভৈরব রেলওয়ে সেতু বোমা মেরে ভেঙ্গে ফেলে।
মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিঃ
স্মৃতি ভাস্কর্য ‘দুর্জয় ভৈরব’
ধর্মীয় প্রতিস্ঠানঃ
মসজিদ ২০৮টি, মন্দির ১৩টি, গীর্জা ৭টি।
স্বাক্ষরতা এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানঃ
কলেজ ৫টি, উচ্চ বিদ্যালয় ১৫টি, জুনিয়র উচ্চ বিদ্যালয় ২টি, মাদ্রাসা ৬টি,সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ৫৮টি,বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ১৭টি। কারিগরী প্রশিক্ষন কেন্দ্র ১টি, সমাজ কল্যাণ প্রশিক্ষন কেন্দ্র ২টি।
উল্লেখযোগ্য প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে জগন্নাথপুর পুরাতন প্রাথমিক বিদ্যালয়(১৮৯৫), হাজী আসমত কলেজ(১৯৪৭), কে. বি. উচ্চ বিদ্যালয়। আঞ্চলিকভাবে প্রকাশিত সংবাদপত্র ও সাময়িকীগুলো হল সাপ্তাহিক মোফাসসালচিত্র এবং সাপ্তাহিক নিরপেক্ষ অরুনিমা।গড় স্বাক্ষরতা ৪৫.১%; পুরুষ ২৭.৮%, মহিলা১৬.৪%
জনসংখ্যাঃ
৩২৪৩২৪ জন।পুরুষ ৫১.৪১%, মহিলা ৪৮.৫৯%; মুসলিম ৮২.৮৪%, হিন্দু১৫.৬৪%; পৌত্তলিক ও অন্যান্য ১.৫২%।
প্রধান পেশাসমূহঃ
ব্রিটিশ আমল থেকে ভৈরব ব্যবসাকেন্দ্র হিসেবে সুপরিচিত। ভৈরবকে তাই অনেক সময় ভৈরব বাজার বলেও অভিহিত করা হয়।
কৃষি ৩১.৩৭%,মাছ ধরা ২.৭৩%,কৃষি মজদুরি ৯.৬৮%,দিনমজুর ৫.১৩%,শিল্প প্রতিষ্ঠান ১.৯৮%,ব্যবসায় ১৯.৫২%, ফেরিওয়ালা ২.১৯%, যানবাহন ৪.০৩%, স্থাপনা ১.৩৮%, চাকুরী ৯.০১%, অন্যান্য১২.৯৮%
সাংস্কৃতিক সংগঠনঃ
পাবলিক লাইব্রেরী ৬টি, থিয়েটার গ্রুপ ৪টি, নাটক মঞ্চ ১টি,নারী সংগঠন ৩টি,সিনেমা হল ৩টি, সেচ্ছাসেবী সঙ্ঘঠন ৬৫টি,শিক্ষা সঙ্ঘ ৩টি।
জমির ব্যবহারঃ
মোট চাষ উপযোগী জমির পরিমান ৯৫৯০.৮৬ হেক্টর,পতিত জমি ৬০হেক্টর, এক-ফসলী ৫৬.৫৪%,দ্বি-ফসলী ৩৯.৩৬%, ত্রিফসলী ৪.১০%; সেঁচের আওতাভুক্ত জমি ৪০১৯.৮৩ হেক্টর।
কৃষকের মাঝে জমির বন্টন ১২.১৬% ভূমিহীন,৫১.২৭%ছোট, ৩০.৩৭% প্রান্তিক, ৫.১৯%মাঝারী, ১.০১%ধনী চাষী।
ফসলঃ
প্রধান শস্য ধান, সরিষা, আলু, মটরঁশুটি, তিল।
বিলুপ্ত বা প্রায় বিলুপ্ত শস্য পাট।
প্রধান ফল আম, কাঁঠাল, কলা, পেঁপে কাল জাম।
মাছ চাষ, পশুপালন, পোল্ট্রিঃ
মাছের খামার ১০টি,পশু খামার ৪৫টি,পোল্ট্রি ৮৫টি, হ্যাচারী ৩টি
যোগাযোগ ব্যবস্থাঃ
পাঁকা রাস্তা ৮০কিমি,আধাপাঁকা ১কিমি, মাটির রাস্তা ৬০কিমি; রেলওয়ে ১৩.১১কিমি; জলপথ ১৭ নর্টিকাল মাইল। ঐতিহ্যবাহী যানবাহন পাল্কি(বিলুপ্ত),পাল তোলা নৌকা।
ভৈরবের বিশাল এলাকাজুড়ে জলাভূমি। বর্ষাকালে এসব এলাকাবাসীর যাতায়াতের একমাত্র বাহন নৌকা। শুধু তাই নয় মাছ ধরা, গরু-বাছুরের জন্য কচুরিপনা ও ঘাস সংগ্রহ এবং হাটবাজারে মালপত্র পরিবহনেও প্রতিটি পরিবারের দরকার হয় নৌকা। ফলে বর্ষা মৌসুম শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ভৈরবে নৌকা তৈরির ধুম পড়ে যায়। পেশাজীবী নৌকার মাঝি ছাড়াও বর্ষা মৌসুমে এক শ্রেণীর লোক নৌকা কিনে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে লোকজন পাড়াপাড় করে নৌকার মাঝি হিসেবে বাড়তি উপার্জন করে থাকে। বর্তমানে এ এলাকায় কোষা নৌকার কদর বেশি। কড়ই, শিমুল ও চাম্বল কাঠের নৌকাই বেশি চলে এখানে।
বন্দরনগরী ভৈরবের রাতের মাছের আড়ত বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ মাছের আড়ত হিসেবে পরিচিত। ভৈরব মেঘনা নদীর তীর ঘেঁষে ২৫ বছর আগে মাছের আড়তটি পলতাকান্দা ও মেঘনা ফেরিঘাটের মধ্যবর্তী স্থানে গড়ে ওঠে। এখানে ২ শতাধিক মাছের আড়ত রয়েছে। এ আড়তকে কেন্দ্র করে এখানে গড়ে উঠেছে শতাধিক বরফ কল, হোটেল, বিভিন্ন মনোহারি প্রশাধনীর দোকান ফলে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে হাজার হাজার লোকের।
বিদ্যুৎঃ
বিদ্যুৎ ব্যবহার এ উপজেলার সবক’টি ইউনিয়ন পল্লিলবিদ্যুতায়ন কর্মসূচির আওতাধীন। তবে ৫৯.৫৬% পরিবারের বিদ্যুৎ ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে।
শিল্পকারখানাঃ
জুট মিল ১টি,স’মিল ১০, লোহার(তারকাটা) কারখানা ২টি, ওয়েল্ডিং ৩৭টি।
হাট, বাজার, মেলাঃ
মোট হাট বাজার ১৩টি,তার মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ভৈরব, শিমুলকান্দী, গজারিয়া, চকবাজার;মেলা ৪টি, উল্লেখযোগ্য ফকির বাড়ি মেলা, সিদ্দীক বাজার মেলা।
প্রধান রপ্তানীজাত পণ্য মাছ, কয়েল, লোহা, জুতা, বিড়ি, বিস্কিট, লুঙ্গি, গামছা।
কুটির শিল্পঃ
স্বর্ণকার ৪২টি,কামার ৪০টি, কুমোর ৭টি।
প্রধান নদী সমূহঃ
মেঘনা,পুরনো ব্রম্মপুত্র(প্রায় মৃত)।
পানীয়জলের উৎস নলকূপঃ
৯৩.৭১%, পুকুর ০.১১%, ট্যাপ ২.০১% এবং অন্যান্য ৪.১৭%। এ উপজেলার ২৯.৯৫% অগভীর নলকূপের পানিতে আর্সেনিকের উপস্থিতি প্রমাণিত হয়েছে।
স্বাস্থ্য কেন্দ্রসমূহ:
উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্র ১টি, উপ-স্বাস্থ্য কেন্দ্র ২টি, পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র ৫টি, রেলওয়ে হাসপাতাল ১টি।
গেস্ট হাউজঃ ০১টি ( জেলা পরিষদের মালিকানাধীন)
১. ভৈরব রেল সেতু (শহীদ আব্দুল হালিম রেলওয়ে সেতু)
২. বাংলাদেশ-যুক্তরাজ্য মৈত্রী সেতু (সৈয়দ নজরুল ইসলাম সড়ক সেতু)
৩. দুর্জয়, ভৈরব (দুর্জয় স্মৃতি ভাস্কর্য)
৪. পানাউল্লার চরের মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ভাস্কর্য (পানাউল্লারচর বধ্য ভূমিতে নির্মিত মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ভাস্কর্য)
৫.প্রাচীন নিদর্শনাদি ও প্রত্নসম্পদ নীলকুঠি (শিমুলকান্দি),
৬.ইমামবাড়ি (শিমুলকান্দি),
৭.গজারিয়া গ্রামের জগবন্ধুর অট্টালিকা, তিতুমিয়ার অট্টালিকা,
৮.ভৈরব বাজারে কারুকার্য খচিত রবীন সাহার অট্টালিকা।
পত্র-পত্রিকা ও সাময়িকী দৈনিকাঃ একুশে কাগজ; সাপ্তাহিক: নিরপেক্ষ অরুণিমা, দিনের গান, উজান স্রোত; অবলুপ্ত সাপ্তাহিক: দিশারী, গ্রাম বাংলা, মফস্বলচিত্র; পাক্ষিক: ভৈরব।
কৃতী ব্যক্তিত্বঃ
১.রেবতী মোহন বর্মণ(১৮৮৯-১৯৫৬)
২.প্রেসিডেন্ট জিল্লুর রহমান (১৯২৯-২০১৩)
৩.আইভি রহমান (১৯৪৬-২০০৪)
৪.নাজমুল হাসান পাপন, বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড এর সভাপতি
আরও অনেকে কৃতি ব্যাক্তি আছেন।
প্রাকৃতিক দুর্যোগ ১৯৭৪, ১৯৮৮, ১৯৯৮ ও ২০০৪ সালের বন্যায় এ উপজেলার ঘরবাড়ি, ফসল, গবাদিপশু ও অন্যান্য সম্পদের ব্যাপক ক্ষতি হয় এবং বহু লোকের প্রাণহানি ঘটে।
যেভাবে যাবেন :
সবচেয়ে ভালো হলো ট্রেনে যাওয়া। প্রতিদিন সকাল ৭টায় এগারসিন্দুর প্রভাতি (বুধবার বন্ধ) ছাড়ে কিশোরগঞ্জের উদ্দেশে। ভাড়া ২০০ টাকা। এ ছাড়া গুলিস্তান ফুলবাড়িয়া থেকে বিআরটিসি বাসে করেও যাওয়া যায়। ভাড়া ২০০ টাকা। শেয়ারে ভাড়া নেবে জনপ্রতি ১০০ টাকা।
কোথায় থাকবেন :
ভাল ও মাঝারি মানে অনেক হোটেল আছে।অনেক ভাল রেষ্টুরেন্ট ও অাছে।
উক্ত তথ্য সম্পর্কে আপনার মাতামত, সংশোধন, পরিবর্ধন বা পরিবর্তনের প্রয়োজন হলে আমাদের কমেন্ট করে জানান।লেখতে গিয়ে ভূল তাকতে পারে।তাই ভূল গুলো জানালে ভাল হয়।
Faysal Ahmed Prodip(Himu).
Post a Comment